গল্প- সুরভী

অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

সুরভী
– সঞ্জিত মণ্ডল

সন্দীপের অফিসে কদিন থেকে খুবই ধকল যাচ্ছে। একটা মেধাবী মেয়ে নাম মানসী, তার রহস্যজনক ভাবে লোপাট হওয়ার ঘটনায় রাজ্যজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সন্দীপ সি আই ডি অফিসার, বিভিন্ন ধরণের তদন্তের কাজে দিন রাত ব্যস্ত থাকতে হয়। কখনো কখনো দিন রাত অফিসেই কেটে যায়, বাড়িতে আসার অবসর হয় না। সেদিন ও তাই হয়েছে, রাত এগারোটা বেজে গেলে সন্দীপ ভাবলো তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সোনালী কে একটা ফোন করে নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানায় আর দু চারটে সোহাগের বাণী বলে তাকে খানিকটা সান্ত্বনা দেয়।
সেই মতে সন্দীপ ফোন করে সোনালী কে, বলে, তোমার সুরভী নিয়ে একটু যে ঘুমাবো তার উপায় নেই। সোহাগের ছলে বলা কথাগুলো শোনা মাত্র সোনালী ঝাঁঝিয়ে ওঠে। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কর্কশ গলায় বলে, দেখো, তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সামনে তুমি সুরভীর নাম মুখে আনবে না। সুরভী তোমার যত পেয়ারের লোক হোক না কেন, তাকে আমি চিনিনা, চিনবো না, চিনতে চাই না। সব পুরুষ মানুষ গুলো এক সমান। বউ যত সুন্দরী হোক না কেন তাকে মনে ধরে না, অন্য মাগী একটু ফুটফুটে হলেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে বাধে না। একজনের কাছে মন বাঁধা দিয়ে বিয়ে মারাতে গেছিলে কেন লজ্জা করে না? তাইতো বলি, আমার দিকে নজর নেই, খালি বাজে অজুহাত দিয়ে বাইরে বাইরে রাত কাটানো, জানোয়ার কোথাকার।
সন্দীপ নির্বাক বিস্ময়ে স্ত্রীর কথা গুলো শুনতে শুনতে ভাবতে লাগলো সে ঠিক কি বলেছে যার জন্যে সোনালী এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপরে। সে তো শুধু বলেছিল, তোমার সুরভী নিয়ে একটু যে ঘুমাবো তার উপায় নেই। সুরভী নাম শুনেই সোনালী এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো কেন। সে নিজেও তো সুরভী নামে কাউকে চেনে না। কে এই সুরভী? কিন্তু সুরভীর চিন্তা মন থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে হয়, কেননা যে মেধাবী মেয়েটি নিখোঁজ হয়েছে তার নাম মানসী। এফ আই আরের ফাইলটা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে কয়েকটা শব্দের নীচে লাল কালির দাগ দেয়। একটা কথা বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় খেলে যায়। দুজন সহকারীকে ডেকে নেয়, রাত তখন দুটো। নিজে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে তাদেরও প্রস্তুত হয়ে নিতে বলে, ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি রাখতে বলে।পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওরা বেরিয়ে পড়ে কৃষ্ণ নগরের দিকে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই ওরা কোতোয়ালি থানায় পৌঁছে যায়, ডিউটি অফিসারকে অতিক্রম করেই ওরা ওসির ঘরে ঢুকে পড়ে। ওসি অরুণাভকে নিজের পরিচয় পত্র দেখায়। ওসি গুড মর্নিং স্যার বলে স্যালুট জানিয়ে সুদীপ্ত কে বসতে অনুরোধ করে। সুদীপ্ত সংক্ষেপে কি করতে হবে কেন করতে হবে সেটা বলে, আটজন আর্মড ফোর্স নিয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশেষ ঠিকানায় রেড করতে বলে।
দুটো গাড়িতে ওরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যে বাড়িতে হানা দিল সেটা সুদীপ্তর শ্বশুর বাড়ি। সুদীপ্ত তিন চার জন বন্দুক ধারি কে নিয়ে বাড়ির চারিদিকে নজর রাখে, অরুণাভ কে বলে রাখে বাড়িতে মহিলা বা পুরুষ যেই থাকুক না কেন, তাকেই যেন গাড়িতে তোলে। এটা যে তার নিজের শ্বশুর বাড়ি সেকথা ঘুণাক্ষরেও কাউকেই জানায় না।
ওসি অরুণাভ ভিতরে ঢোকার পর আধঘন্টা কেটেছে, পর পর দুবার গুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে। সুদীপ্তর উৎকন্ঠা যখন চরম সীমানায় তখনই দুটো লোককে হিড়হিড় করে টানতে টানতে গাড়িতে তোলে।
সুদীপ্ত খুব কঠিন গলায় বলে, তুমি নিজে বলবে অথবা থার্ড ডিগ্রি চাইছ। সুদীপ্তর মেজশালা বাদল চোখ লাল করে বলে, ও তুমি ই তাহলে আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছ। তাই বলি, এই না হলে জামাই। সুদীপ্ত অরুণাভ কে ঈশারা করা মাত্রই অরুণাভর কনুই টা বাদলের মোক্ষম জায়গায় আঘাত করে, বাদল রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হয়ে যায়। বলে, বেথুয়া ডহরির মৃগদাবর দিকে যেতে হবে। অরুণাভ কঠোর গলায় বলে, বেচাল দেখলে ওইখানে তোকে পুঁতে দেবো। গাড়ি ছুটতে থাকে বাংলাদেশ বর্ডার বরাবর। এক সময় ওরা বেথুয়া ডহরির বিভূতি ভূষণ অভয়ারণ্যে পৌঁছে যায়। ঢুকেই ডান হাতে একটা রাস্তা সরাসরি ইছামতীর দিকে এগিয়ে গেছে, ঘাটের পাশেই একটা কাঠের গুদাম। বাইরে থেকে চাবি বন্ধ করা আছে। দুটো লোক বাইরে বসে খৈনি বানাচ্ছিল, পুলিশ দেখেই দৌড়ে নদীর ঘাটের দিকে পালানোর চেষ্টা করলো। বন্দুক ধারি সেপাইরা হল্ট হল্ট করতে করতে পিছনে ছুটে গিয়ে বললো, রুক যাও, নেহিতো গোলি মার দুঙ্গা। লোক দুটো তোয়াক্কা না করে নদীতে ঝাঁপ দিল। নদীতে প্রচুর কচুরিপানার মধ্যে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো। একটু দূরে কয়েক জন মাঝি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিল, পুরো ব্যাপার টা দেখে আর পুলিশের কথা শুনে লোক দুটো কে বললো, ভালোয় ভালোয় উঠে এসো, নাহলে লগির খোঁচায় এখানেই তলিয়ে যাবে। লোক দুটো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নৌকায় উঠতেই হঠাৎ ভুটভুটি নৌকা ইঞ্জিন চালু করে লোক দুটোকে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে গেলো। এপার থেকে গুলি চালিয়ে ও ওদের নাগাল পাওয়া গেল না।
এদিকে তালা বন্ধ দরজা ভেঙ্গে মুখ বাঁধা অবস্থায় মানসীকে পাওয়া গেলো সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন অবস্থায়। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কোনোমতে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে ওরা কলকাতার দিকে রওনা দেয়। মানসীকে অত্যন্ত কড়া পাহারায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েই পার্ক স্ট্রীটে নিজের কোয়ার্টারে মহিলা আর্মড ফোর্স নিয়ে হাজির হয়। তার স্ত্রী সোনালী দরজা খোলা মাত্র সে ইশারা করে, সোনালী এ্যরেষ্ট হয়ে যায়। সুদীপ্ত অফিসে ফিরে অবসন্ন হয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়।
মূহুর্তে মানসী উদ্ধারের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এও রটে যায় সি আই ডি অফিসার সুদীপ্তর নিকট আত্মীয় এমনকি তার স্ত্রী ও এ্যরেষ্ট হয়েছে। শুধু সাংবাদিকরা নয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও জানতে চায় সুদীপ্ত এই রহস্য উন্মোচন করলো কিভাবে।
সুদীপ্ত বললো সুরভী শব্দটা এই রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করেছে । আর সাহায্য করেছে আমার নিজের বিবাহিত স্ত্রী। সে যদি সুরভী এই সামান্য কথায় সাংঘাতিক রেগে গালিগালাজ না করতো তবে আমার পক্ষে এ রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হতো না। ওর কাছে বিনাকারণে অসহ্য গালি খেয়ে মানসীর ফাইল ঘাঁটতে শুরু করি, ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি মানসীর ডাক নাম সুরভী। ব্যাপার টা আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। আমার স্ত্রী ই তার সঙ্গে পুরানো বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে মানসীকে কৃষ্ণ নগরে দাদাদের হাতে তুলে দেয়, দাদারা তাদের ব্যবসায় মন্দার কারনে মানসীকে বাংলাদেশে বিক্রি করে দেবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে।
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করে, কিন্তু কেন আপনার স্ত্রী তার নিজের বন্ধুর এমন সর্বনাশ করতে উদ্যত হলো?
সুদীপ্ত বলে আদিম ঈর্ষা! আমার ফুলশয্যার রাতে মানসী নাকি একটু বেশী উৎসাহ দেখিয়ে ফেলেছিল, সেটা আমার স্ত্রীর ভালো লাগেনি। তার জন্যেই এই চরম পদক্ষেপ। আমি বড়ো ক্লান্ত, এবার আমাকে ক্ষমা করুন, আপনারা আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

Loading

One thought on “গল্প- সুরভী

  1. আমার আন্তরিক ধন্যবাদ আর অন্তহীন শুভেচ্ছা জানাই প্রিয় বন্ধু, আলাপী মন সব কিছু মনের কথা বলে, লেখক ও কবিরা উন্মুখ হয়ে শোনে সে কথা, তাদের ভালো লাগে, তাদের মধ্যে আমিও একজন, আমারও ভালো লাগে। আলাপী মন মন ছুঁয়ে যায়।

Leave A Comment